সময় থেমে থাকে না , সময় এগিয়ে চলে । প্রায় ২৫ বছর পর রেলগাড়ির এই যাত্রাপথে ট্রেনের কামরায় বসে নির্মলের অনেক কথাই মনে পড়ছিলো। " পলাশপুর " গ্রামে নির্মলের জন্ম আর এই গ্রামেই জীবনের অনেকটা বছর কাটানো। তাদের এই গ্রামটি ছিল একেবারে ছবির মতো। বিভিন্ন ঋতুতে বিভিন্ন রূপ। তবে বর্ষাকালের রূপটাই তার কাছে ছিল প্রিয়। একটু বেশি বর্ষা হলেই মাঠঘাট , রাস্তা একেবারে জলে জলাকীর্ণ হয়ে যেত। আর বৃষ্টির মধ্যেই দুপুরবেলা বাড়ির লোকজনদের না জানিয়ে সৌরভীকে সঙ্গে নিয়ে আম বাগানে গিয়ে আম কুড়োনো ---- , মনের স্মৃতির ঘটনাগুলো রোমান্থনের মাঝে পাশের সহযাত্রী বললেন - দাদা , ট্রেন পলাশপুর স্টেশনে ঢুকছে ---- পলাশপুর রেল স্টেশনে যখন গাড়ি এসে দাঁড়ালো , তখন সূর্য পশ্চিম দিকে তার মলিন আলোর আভা নিয়ে সেদিনটার মতো হারিয়ে যাচ্ছে।
আজ থেকে প্রায় ২৫ বছর আগে এইরকম এক জ্যৈষ্ঠ মাসের মাঝামাঝি সময়ে নির্মল তার এই ভালোবাসার গ্রাম ছেড়ে চলে যায় মনের ভিতর একরাশ কষ্টের যন্ত্রনা নিয়ে। এইখানে থাকলে তার সৌরভীর সঙ্গে সেই বৃষ্টি ভেজা বিকেলের আম কুড়োবার দিনটির কথা সবসময় মনে পরে। পলাশপুর স্টেশনে নেমে একবার ভালো করে চারিদিকটা দেখে নিয়ে মনেমনে ভাবলো এটাই কি পলাশপুর ? ২৫ বছর আগেকার পলাশপুর স্টেশনের সঙ্গে বর্তমানের কোনো মিলই খুঁজে পেলো না। অনেক পরিবর্তন হয়ে গেছে জায়গাটির। জ্যৈষ্ঠ মাসের মাঝামাঝি সময় , কিন্তু চারিদিক দেখে মনে হচ্ছে বেশ কয়েকদিন এখানে বৃষ্টি হয় নি। আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখলো - কিছুকিছু কালো মেঘ পুন্জীভুত হচ্ছে , এই প্রচন্ড গরমে বৃষ্টি হলে ভালোই হতো কিছুটা হয়তো স্বস্তি পাওয়া যেত। কিন্তু আজও নির্মল বৃষ্টির সঙ্গে বিদ্যুতের ঝলকানি , বজ্রপাতের আওয়াজকে ভীষণ ভয় করে আর তার মনে পড়ে যায় সেই ভয়ঙ্কর দিনটির কথা ---। হটাৎ করে তার নাম ধরে কেউ ডাকতে সম্বিৎ ফিরে একটুক্ষণ তাকিয়ে থেকে চিনতে পারে তার ছোট কাকাকে। ছোট কাকা তাকে চিনতে পেরে কাছে টেনে নিয়ে বললেন - নির্মল , তুই কত বছর পর আমাদের গ্রামে এলি। অবশ্য তুই যখন গ্রাম ছেড়েছিলি তখন এই পলাশপুর ছিল সত্যি একটা সুন্দর গ্রাম কিন্তু আজ আর পলাশপুর গ্রাম নেই , অনেক পরিবর্তন হয়ে গেছে। এখন পলাশপুরকে তুই আধা শহর বলতে পারিস। নির্মল বললো - ঠিকই বলেছো কাকা , আমার স্মৃতিতে থাকা সেই পলাশপুরকে আমি এখন আর খুঁজে পাচ্ছি না। তুই কয়েকদিনের জন্য পলাশপুরে তোর পৈতৃক ভিটে বাড়িতে বেড়াতে আসবি সেই খবর আমরা ঠিক সময় পেয়েছি। এই খবর শুনে আমরা খুব খুশী হয়েছি। আজ তুই আমেরিকায় থাকিস , কত ভালো চাকরি করিস এসব জেনে আমাদেরও খুব ভালো লাগে। কয়েকটা দিন আমরা সবাই তোকে নিয়ে খুব আনন্দ করে কাটাবো। এবার চল আমরা বাড়ির দিকে যাই , বাড়িতে সবাই তোর জন্য অপেক্ষা করে আছে।
নির্মলের পুরোনো বন্ধু - বান্ধব যারা এখনো এই পলাশপুরে রয়েছে তাদের সঙ্গে দেখা করে , গল্পগুজব করে বেশ ভালোই লাগলো। পলাশপুরে বন্ধুদের মধ্যে নির্মলের সবথেকে প্রিয় বন্ধু ছিল পরেশ। গ্রামে থাকাকালীন পরেশের সঙ্গে নির্মল তার জীবনের প্রায় সব কথাই আলোচনা করতো। আজ দুপুরবেলায় পরেশের বাড়িতে তার নিমন্ত্রণ ছিল। পরেশের স্ত্রী উর্মিলা অনেক রকমের খাবারের আয়োজন করেছে। প্রায় ২৫ বছর পর দুই বন্ধু মিলে পুরোনো দিনের অনেক গল্প , হাসি ঠাট্টা করতে করতে হটাৎ করে পরেশ বললো - তোর জীবনে সেদিন ওই ঘটনাটা ঘটে যাবার পর কাউকে কিছু না জানিয়ে তুই কলকাতা চলে গেলি তারপর কলকাতা থেকে একেবারে সরাসরি আমেরিকা। এখন আমেরিকাতে তুই খুব বড় কোম্পানিতে কাজ করছিস। একটা কথা আমাকে বল , তুই আজ অবধি কেন বিয়ে করিস নি ? অন্তত কেউ না জানুক আমি জানি তুই সৌরভীকে খুব ভালো বাসতিস। এই কারনেই তুই কি অন্য মেয়েকে বিয়ে করিসনি ? নির্মল একটুক্ষণ চুপ করে থেকে তার এতক্ষন হাসিহাসি মুখটা বদলে এক করুন দৃষ্টি দিয়ে মাথাটা নাড়িয়ে বললো - হ্যাঁ , ঠিক তাই।
স্মৃতির জোয়ারে নির্মল পিছিয়ে গেলো আজ থেকে ২৫ বছর আগের এক বৃষ্টি ভেজা বিকেলের দিনে -----
নির্মলের বয়স তখন ২১ কিংবা ২২ আর সৌরভীর তখন ১৬ কিংবা ১৭। সেদিন সকাল থেকে আকাশটা ঘন কালো মেঘে ঢেকে গেলো। বোঝা গেলো কোনো এক মহা প্রলয়ের পূর্বাভাস। ঝড়টা উঠলো দুপুরের একটু পরে। ঝোড়ো হাওয়ার সঙ্গে শুরু হলো মুষুলধারে বৃষ্টি। ঝড়ের দাপটে সবকিছু একেবারে লণ্ডভণ্ড করে দিলো। ঝড়ের দাপট আর বৃষ্টিটা কমলে নির্মল সৌরভীদের বাড়িতে গিয়ে বললো - সৌরভী , আমার মনে হচ্ছে আজ দুপুরের ঝড়েতে " রায়বাবুদের " আম বাগানে অনেক আম পরেছে। যাবি আম কুড়োতে ? অনেক আম পাওয়া যাবে যদিও এখনও অল্প অল্প বৃষ্টি হচ্ছে। সৌরভী বেশ উৎফুল্ল হয়ে বললো - নির্মল দা , আমিও ঠিক এটাই ভাবছিলাম। চলো আমরা বেড়িয়ে পরি , বৃষ্টিটা এখন অনেকটাই কম। দুজনে মিলে দুটো ব্যাগ নিয়ে গ্রামের মেঠো পথ ধরে অল্প বৃষ্টির মধ্যেই " রায়বাবুদের " আম বাগানের দিকে যেতে যেতে হটাৎ করে বিদ্যুৎ চমকিয়ে এক বাজ পরার শব্দ হলো। সৌরভী ভয় পেয়ে নির্মলের হাতটা চেপে ধরলো। নির্মল সৌরভীকে বললো - ভয় পাস না , আমিতো তোর সঙ্গে আছি। সৌরভী বললো - সত্যি , তুমি আমার সঙ্গে থাকবে তো ? নির্মল বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে সৌরভীর দুটো গাল ধরে আরো কাছে টেনে নিয়ে কানে কানে বললো - আমি সব সময় তোর সঙ্গেই থাকবো। সৌরভী , আমি তোকে খুব , খুব ভালোবাসি। সৌরভী বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে সুন্দর একটা ভালোবাসার চাউনি দিয়ে ফিশ ফিশ করে বললো - নির্মল দা , তুমি সত্যি বলছো তো ? আমিও তোমাকে ভীষণ ভীষণ ভালোবাসি। আজ তোমাকে আমার একটা মনের কথা বলি - তোমাকে এক মুহূর্তের জন্য দেখতে না পেলে আমি কি রকম যেন একটা অসহায় বোধ করি , আমার তখন কিছুই ভালো লাগে না। মনে হয় এক ছুটে তোমার কাছে চলে যাই। নির্মল সৌরভীকে আরো কাছে টেনে নিয়ে আদর করে বললো - আমি যে মনের কথাটা তোকে এতদিন বলতে পারিনি আজ সেটাই তোকে বলছি - আমি সত্যি তোকে খুব ভালোবাসি। নির্মল আকাশের দিকে তাকিয়ে বললো - বৃষ্টিটা এখন অনেক কম কিন্তু আকাশের যা অবস্থা যেকোনো সময় জোরে নামতে পারে। তাড়াতাড়ি চল আম বাগানে , অনেক আম হয়তো পরে রয়েছে।
আম বাগানে গিয়ে বৃষ্টি ভেজা এই বিকেলবেলায় দুজনে মিলে মনের আনন্দে আম কুড়িয়ে ব্যাগে ভরতে লাগলো। নির্মল বললো - সৌরভী , বৃষ্টি আবার জোরে পরতে শুরু করেছে , আম কুড়োবার আর দরকার নেই। সৌরভী বললো - জোরে বৃষ্টির মধ্যে ভিজে ভিজে আম কুড়োবার একটা আলাদা মজা আছে। তুমি এখানটায় একটুক্ষণ দাড়াও , সামনের ওই বড় গাছটার তলায় মনে হচ্ছে অনেক বড় বড় আম পরে রয়েছে। এই বলে সৌরভী দৌড়ে গেলো বড় গাছটার তলায় আম কুড়োবার জন্যে। আর ঠিক সেই মুহূর্তে ঘটলো এক ভয়াবহ দুর্ঘটনা। বৃষ্টির সঙ্গে একটা ভয়ঙ্কর বিদ্যুতের ঝলকানি আর তার সাথে সাথে সারা পলাশপুর গ্রামকে একেবারে কাঁপিয়ে দিয়ে এক কানফাটা বিকট বাজ পরার শব্দ। এতটাই এর তীব্রতা মনে হলো সারা পৃথিবী যেন ধংশ হয়ে গেলো। ক্ষনিকের মধ্যে সম্বিৎ ফিরে পেয়ে নির্মল চিৎকার করে বললো - সৌরভী , আর আম কুড়োতে হবে না এবার বাড়িতে চল। কিন্তু সৌরভীর কোনো সাড়াশব্দ নেই। তাকিয়ে দেখলো বড় আম গাছটার নিচে সৌরভী শুয়ে রয়েছে। নির্মল দৌড়ে কাছে গিয়ে দেখলো - ব্যাগ ভর্তি আমগুলি সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে পরে রয়েছে আর সৌরভীকে একেবারে চেনাই যাচ্ছেনা। সৌরভীর ফর্সা গায়ের রঙ নিমেষে পরিবর্তন হয়ে কালো কুচকুচে হয়ে প্রাণহীন দেহটা কুঁকড়ে গাছের তলায় পরে রয়েছে। এই দৃশ্য দেখে নির্মলের আর কিছু বোঝার বাকি থাকলো না , একটা জিনিস থত্ক্ষনাৎ উপলব্ধি করলো তার নিজের জীবনটাতে প্রাণ থেকেও সে একেবারে প্রাণহীন হয়ে গেলো চিরতরের জন্য ।
উর্মিলার ডাকে নির্মলের স্মৃতির ভাবনায় ছেদ পড়লো। উর্মিলা বললো - নির্মল দা , বাহিরে মুষুলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। আপনি দরদর করে ঘামছেন। আপনার কি শরীর খারাপ লাগছে ? আপনি বরং পাখাটার তলায় সরাসরি বসুন হাওয়াটা বেশি পাবেন। নির্মল স্বাভাবিক হয়ে বললো - উর্মিলা , না না আমি ঠিক আছি। জানিস পরেশ , যদিও তোর থেকে শুনেছি রায়বাবুদের আম বাগানটির বর্তমানে কোনোই অস্তিত্ব নেই তবুও কেন জানিনা এখানে আসার পর এক তীব্র আকর্ষণ বোধে আমি এর মধ্যে একদিন রায়বাবুদের আম বাগানের জায়গাটায় গিয়েছিলাম। গিয়ে দেখলাম এত বছর পর সেই বিশাল আম বাগানটার কোনো অস্তিত্ব নেই। সেখানে বিশাল এক স্কুলবাড়ি হয়েছে আর বাকি বড় ফাঁকা জায়গাটায় একটা খেলার মাঠ। মোটামুটি আন্দাজ করে ফাঁকা মাঠটায় যেখানে সৌরভী আমার সঙ্গে এই রকমই এক বৃষ্টি ভেজা বিকেলবেলায় আম কুড়োতে এসে বজ্রাঘাতে মৃত্যুর কোলে ঢোলে পরেছিলো সেই জায়গাটায় এসে দাঁড়ালাম। কাকতালীয় ভাবে সেদিনও বজ্রবিদ্যুৎ সহ বৃষ্টি হচ্ছিলো। এত বছর পরেও হটাৎ করে মনে হলো সৌরভী যেন আমাকে কানে কানে বলছে - নির্মল দা , এই বৃষ্টির মধ্যে আর দাঁড়িয়ে থেকো না। দেখতে পারছো না বৃষ্টির সঙ্গে মাঝে মাঝে জোরে বিদ্যুৎ চমকিয়ে বাজ পরছে। তুমি তাড়াতাড়ি এখন থেকে চলে যাও , যেকোনো সময় তোমার কোনো বড় বিপদ হতে পারে। নির্মল দা , তুমিতো ভালো করেই জান আমি যে তোমাকে আমার প্রাণের থেকেও বেশি ভালোবাসি।
লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা
ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য
স্মৃতি কখনো মধুর আবার কখনো কষ্টের। এক কষ্টের স্মৃতিকে নিয়ে এই গল্পটি লেখবার চেষ্টা করেছি।
১২ আগষ্ট - ২০১৭
গল্প/কবিতা:
৪৭ টি
সমন্বিত স্কোর
৫.৩৫
বিচারক স্কোরঃ ২.৩৫ / ৭.০
পাঠক স্কোরঃ ৩ / ৩.০
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪